রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি।
খাগড়াছড়ির সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিলের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য শহর রাঙামাটিতেও। শুক্রবার সকালে শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে পাহাড়িদের একটি মিছিল বের হয়ে বনরূপায় গেলে সেখানে মিছিলে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে বাঙ্গালিদের বেশ কিছু দোকানপাট, মসজিদের কাচ ভাঙচুর করে মিছিল কারিরা। তারা এইসময় রাস্তায় চলাচলকারি বাস, ট্রাক, টেক্সি, ভাঙচুর করে। এরপরই লাঠিসোঠা হাতে মাঠে নেমে পড়ে বাঙালিরাও। তাদের পাল্টা হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাঁঠালতলীতে অবস্থিত মৈত্রী বিহার, লুটপাট করা হয় বিহারের দানবাক্সের অর্থ। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় বনরূপায় পাহাড়িদের মালিকানাধীন দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় আঞ্চলিক পরিষদের সাতটি গাড়ি। দু’পক্ষের আগুনে পুড়ে যায় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামে পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যরা। এই ঘটনায় আনুমানিক ২৫ বছরের এক যুবক মারা গেলেও তার নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ঘটনায় ৫৩ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন দুপুর একটা থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। হামলার ঘটনায় শহরে অর্ধ-শতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ্রের দাবি, মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে বনরূপায় বাঙালিরা তাদের মিছিলে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে, এতে তাদের বেশকয়েকজন কর্মী আহত হয়। এরপর দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। বাঙালিরা অভিযোগ করেন, পাহাড়িদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে বনরূপা মসজিদ মার্কেট ও মসজিদ মার্কেট সংলগ্ন জামে মসজিদে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পাহাড়িদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা শুরু হয়।
আব্দুর রহিম নামে আহত হওয়া এক যুবক বলেন, সকালে আমি বনরূপাতে ছিলাম। পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপা ঘুরে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই বাঙালিদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। মসজিদে ইট মেরে কাচ ভাঙচুর করে। এসময় তাদের ইটের আঘাতে অনেকেই আহত হয়। আমার হাতে একটি ইট পড়ে। এখানকার ফার্মেসিতে চিকিৎসা নিয়েছি। ভয়ে হাসপাতালের দিকে যেতে পারছি না।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উন্মেষের সভাপতি প্রিন্সি চাকমা বলেন- প্রো বেটার লাইফ (পিবিএল) অফিসে সকালে গিয়েছিলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের সাথে ছিল। হঠাৎ দেখি আমাদের অফিসের নিচে আগুন লাগানো হয়েছে। পরে সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করতে আসেন। আমরা যখন সেনাবাহিনীর গাড়িতে উঠি তখনও বাঙালিরা আমাদের ওপর হামলা করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে আমাদের নিরাপদ স্থানে ছেড়ে আসে সেনা সদস্যরা। এসময় আমাদের সাথে থাকা চার জন শিশু শিক্ষার্থীকে হারিয়ে ফেলি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেই শিশুদের উদ্ধার করা হবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন।
ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরন ডক্টরস ল্যাবে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ডা. অসিত বরণ দাম। তিনি বলেন- আমি ল্যাবে যাইনি। স্টাফরাও সেখানে নেই। আমাদের ল্যাবে ভাঙচুর করা হয়েছে এবং আশেপাশের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে বলে শুনেছি।
রাঙামাটি পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, সকালে পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপায় এসে ফিরে যাওয়ার সময় বনরূপায় বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বনরূপা মসজিদে হামলা ও ভাঙচুর করে বলে জানতে পেরেছি। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপরই বাঙালি ব্যবসায়িরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। এসময় ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়।
এদিকে বিক্ষোভকারীদের আগুনের ঘটনায় ফাইবার অপটিকের কেবল পুড়ে যায়। ফলে রাঙামাটি শহরে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইয়েস নেট-এর পরিচালক মো. শাহীন। তিনি বলেন, পাহাড়ি মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে ফাইবার অপটিকের কেবল পুড়ে যায় এবং ইন্টারনেট সেবা ব্যহত হয়।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার(আরএমও) শওকত আকবর জানিয়েছেন, হাসপাতালে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে ১৯জন ভর্তি রয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এক যুবকের মরদেহ হাসপাতালে রেখে গেছে। তার কোনও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ আমরা পাচ্ছি না।
রাঙামাটি সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মু. সাইফুল উদ্দিন জানিয়েছেন, কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে মামলা ও গ্রেফতার করা হবে।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ও জনসাধারণের জানমালের ক্ষতি সাধনের আশঙ্কায় রাঙামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। শুক্রবার দুপুরে এক গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৪৪ ধারা জারি করেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১১৪ ধারা বহাল থাকবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ১৪৪ ধারা জারির পর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তিনি সকলকে শান্ত থাকার আহবান জানান।