সাতক্ষীরা প্রতিনিধি।।
পানির গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতি বছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের থিম হল ‘শান্তির জন্য জল’। যা বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধিতে জলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সরকারি ও বেসরকারী ভাবে দিবসটি পালন করা হয় এবং দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
পানি দিবস যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। জলের অপর নাম জীবন। এক দিন ভাত না খেয়ে থাকা যায় কিন্ত জল না খেয়ে থাকাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই পানির গুরুত্ব জেনেও আমরা এর অপচয় করি।
কিছু মানুষ আমরা জলের গুরুত্ব জেনেও সুপেয় পানি ও ব্যবহারের পানি অপচয় করে থাকি। ধীরে ধীরে কমছে ভূগর্ভস্থ পানি। কলকারখানা, রান্না, খাওয়া, ব্যবহারে নিচের পানি ব্যবহার করছে মানুষ। শেষ হচ্ছে নিচে ও উপরের পানি। বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে নিচে ও উপরের পানি কমছে মাত্রা তিরিক্ত। উপকূলীয় এলাকায় পানি সংকট বাড়ছে। বাড়ছে পানিতে লবনাক্ততা। বাড়ছে পানি কেন্দ্রিক নানা সমস্যা। তাই প্রতি বছর এই পানি সংকটের বার্তা পৌঁছে দিতেই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জল দিবস। জানা যায়, ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ থেকে বিশ্বের জল দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বিশিষ্ট জনের মতে উপকূলে সুপেয় পানির সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের সুন্দরবন এলাকার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় বিশুদ্ধ পানি সংকট বাড়ছে। বিশিষ্ট জনের মতামত অনুযায়ী উপকূলের পানি সহ স্থল ভাগে লবনাক্ততা বাড়ছে। বিশেষ করে শুস্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ পানি সংকট ও লবণাক্ততার প্রকোপ বাড়ছে।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, উপকূলের সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগরে পুকুরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমান ১৫০ থেকে ২৫০ পিপিএম। টিউবওয়েলের পানিতে লবনাক্ততার পরিমান ২৫০০ থেকে ৪০০০ পিপিএম। জায়গা বিশেষ কম বেশি রয়েছে লবণাক্ততা। বেসরকারী সংগঠন লির্ডাসের অ্যাডভোকেসি অফিসার তমালিকা মল্লিক এক প্রতিবেদনে জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে গত ৩৫ বছরে পূর্বের তুলনায় লবণাক্ততা বেড়েছে ২৬% এবং যার পরিমান ২পিপিটি থেকে বেড়ে ৭পিপিটি হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ভূ-ভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত লোনা পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে মানুষকে পানি ও খাবারের সাথে তুলনামূলক বেশি পরিমান লবণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে লবণাক্তাবৃদ্ধি মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। চিকিৎসাবিদদের মতে, এ এলাকায় বসবাসকারীদের উচ্চ রক্তচাপ রোগে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ছে। লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীদের জরায়ু সংক্রমণ হচ্ছে। শ্যামনগর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলায় পানিতে আয়রনের পরিমান রয়েছে প্রতি লিটারে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম। উপজেলার পানি পরীক্ষা করে দেখে গেছে আর্সেনিক নেই।
উপকূলে সুপেয় পানি প্রাপ্যতা কম হওয়ার কারণ হিসাবে লির্ডাসের অ্যাডভোকেসি অফিসার তমালিকা মল্লিক প্রতিবেদনে জানান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির আধার নষ্ট হওয়া, অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষের কারণে পানিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়া, নিচের পানি উত্তোলনের কারণে শুস্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, সরকারি খাস খাল ও পুকুর ইজারা দেওয়া, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তির অভাব,আয়রণ দুষণ প্রমুখ।
বাংলাদেশের উপকূলের ১৯টি জেলায় প্রায় ৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের বসবাস। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ বৃষ্টির পানির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশেষ উপকূলীয় এলাকায় মানুষ বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে খাবার কাজে, ফসলের ক্ষেতে সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। উপজেলা উপ-সহকারী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান শ্যামনগর উপজেলায় খাবার পানির উৎস সমূহ হল গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট, পিএসএফ, কমিউনিটি নলকুপ ও রিভার্স অসমোসিস। গবাদি পশু, মানুষের গোসল, রান্না সহ অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পানি দীঘি, পুকুর, নদী ও খালের পানি। শ্যামনগর উপজেলায় প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের বসবাস। সুপেয় পানি সমস্যা সমাধানে উপজেলার বারটি ইউনিয়নে স্থাপনকৃত সরকারি ভাবে পিএসএফ অর্থাৎ পন্ড স্যান্ড ফিল্টার ২৫০টি বেসরকারী ভাবে ৫০০টি। গভীর নলকুপ সরকারি ভাবে স্থাপনকৃত ৪৫০০টি বেসরকারী ভাবে ২০০০টি। অগভীর নলকুপ সরকারিভাবে ৫০টি । রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট বা পানির ট্যাংকি পরিবার পিছু সরকারি ভাবে ৫০০০টি বেসরকারী ভাবে ২৫০০টি। কমিউনিটি নলকুপ সরকারি ভাবে ১৮টি ও বেসরকারী ভাবে ২৫টি। কমিউনিটি রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট সরকারি ভাবে ১৩টি বেসরকারী ২৫টি। রিভার্স অসমোসিস সরকারি ভাবে স্থাপনকৃত ৫টি এবং বেসরকারী ভাবে ১০০টি। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন বেসরকারী ভাবে স্থাপনকৃত রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট গুলি মনিটরিং করা প্রয়োজন। এ প্লান্টে ব্যবহারিত কার্বন ফিল্টার ৬ মাস পর পর পরিবর্তন করা দরকার, আরও মেমব্রেন ২ বছর পর পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে জানান। কিন্ত বেসরকারী ভাবে স্থাপনকৃত প্লান্ট গুলিতে নিরাপদ পানি সরবরাহে এগুলি ঠিক ভাবে নিয়ম মেনে চলা হয় কিনা তিনি সঠিক জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, তাদের মনিটরিং করার নির্দেশনা না থাকায় রিভার্স অসমোসিস প্লান্টগুলি মনিটরিং করতে পারেননা।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী কর্মকর্তা বলেন,শ্যামনগর উপজেলার সকল ইউপিতে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে তবে শুস্ক মৌসুমে সুপেয় পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। সাধারণত এই এলাকায় বিভিন্ন স্থানে দুই কিলোমিটার দূর থেকে নারী ও পুরুষ সুপেয় পানি সংগ্রহ করে থাকেন। পিএসএফ গুলিতে দীর্ঘ কলসের লাইন দেখলে বোঝা যায়, পানির সংকট কেমন রয়েছে। পানি সংগ্রহ করতে যেয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও মাঝে মধ্যে ঘটে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায় বলে উপ-সহকারী প্রকৌশলী কর্মকর্তা জানান। মানুষের গোসলের পানি, রান্নার পানি, নিত্য ব্যবহার্য পানি, গবাদি পশুর খাবার পানির ফসলের ক্ষেতে ব্যবহারের পানিরও সংকট বেশ আছে বলে তিনি জানান। লবন পানিতে গোসল করার কারণে মানুষের চর্মরোগ দেখা যায় বলে চিকিৎসকরা জানান। উপ-সহকারী প্রকৌশলী কর্মকর্তা রান্না ও নিত্য ব্যবহার্য কাজে পুকুরের পানি ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। যদি পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হয় সেক্ষেত্রে ফিটকারি, পানি শোধন ট্যাবলেট ব্যবহার করার কথা বলেন।
বেসরকারী সংগঠন লির্ডাসের প্রতিবেদন সুত্রে প্রকাশ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সুপেয় পানি প্রাপ্যতায় দাবী সমূহ হল সুপেয় পানি সংকট এলাকা ঘোষণা করা, বাজেটে বিশেষ বরাদ্ধ রাখা, খাবার পানির সংকট সমাধানে টেকসই ও স্থায়ী সমাধান করা, ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে পানির উৎস সংখ্যা বৃদ্ধি করা, উপকূলীয় বোর্ড গঠন করা, পতিত বা খাস জমিতে জলাধার নির্মান, উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
জলসম্পদ রক্ষা ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসটিতে বিভিন্ন কর্মসূচি সরকারি বেসরকারী ভাবে গ্রহণ করা হয়। জল বা পানি ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন বিধায় দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়ে আসছে। জল সংরক্ষণ ও নাগরিকদের জন্য বিশুদ্ধ জল প্রয়োজন এমন সব গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশিষ্ট জনেরা পানি দিবস গুরুত্ব সহকারে পালন করারও আহব্বান জানান। মানব জাতিকে যেন পানি সংকটের দিন না দেখতে হয় তাই প্রতি বছর গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করা হয় বলে বিশিষ্টজনেরা মতামত প্রকাশ করেন।