ঢাকা জেলা প্রতিনিধি-
মীরজাফর, নবাব কে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি করেছে এই খবর পাওয়ার পর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে সেনাপতির পদ থেকে বরখাস্ত করলেন। ওদিকে মীর জাফরের সঙ্গে চুক্তিমতো ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্য পলাশীর ” লাক্ষাবাগ ” এ ( এক লক্ষ গাছের বাগান ) হাজির হয়। যুদ্ধের জন্য নবাবও তৈরি হলেন। এই সময় নবাবের শুভাকাঙ্ক্ষী মীরমর্দন ও আব্দুল হাদী খান পরামর্শ দেন, অবিলম্বে মীরজাফরকে হত্যা করা হোক। অপরদিকে তখনকার প্রভাবশালী মীরজাফরের সহযোগীরা নবাব কে পরামর্শ দিলেন, মীরজাফরের মতন অভিজ্ঞ শক্তিশালী সেনাপতি ছাড়া ইংরেজদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। নবাব প্রভাবশালী দ্বিতীয় পক্ষের পরামর্শ মেনে নিয়ে মীরজাফরকে পুনরায় সেনাপতি নিযুক্ত করে পলাশীর প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন বাংলার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ঐতিহাসিক ইউসুফ আলী খান লিখেছেন, ” এই যুদ্ধে নবাবের পক্ষে ছিল ৩৫,০০০ পদাতিক সৈন্য, ১৫,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য এবং ৩৫ টি কামান। এই সৈন্যের মধ্যে মোহনলালের অধীনে ছিল ৫,০০০ অশ্বারোহী এবং মীরমর্দনের অধীনে ছিল ৭,০০০ পদাতিক সৈন্য। বাকি সৈন্য ছিল মীরজাফরের অধীনে। অপরদিকে ইংরেজদের ছিল মাত্র ৩,০০০ সৈন্য। তারমধ্যে ২,৩০০ দেশি এবং ৭০০ ইংরেজ সৈন্য এবং তিনটি কামান। দু’পক্ষের এক অসম যুদ্ধ শুরু হল। নবাব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। মিরমর্দন, মহানলালের নেতৃত্বে নবাব বাহিনী বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথম আক্রমণেই ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলার জয় ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটি কামানের গোলার আঘাতে সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি মিরমর্দন নিহত হন। এই খবর শুনে নবাব মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি মীরজাফরকে তার কাছে ডেকে পাঠান এবং মাথার পাগড়ী মীরজাফরের পায়ের কাছে রেখে, নবাবের সম্মান রক্ষা করার জন্য আকুল আকুতি মিনতি জানায়। সমসাময়িক ঐতিহাসিক ” মোজাফফর নামার ” লেখক বলেন, আমি শুনেছি যে মীর মোহাম্মদ জাফর আলি খান, সেই সময়ই নবাব কে হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু নবাবের অসংখ্য সৈন সেখানে উপস্থিত থাকার কারণে তিনি-তা করতে সক্ষম হননি। সিরাজউদ্দৌলার কাতর আবেদনে মীরজাফর নবাব কে পরামর্শ দেন, আজকের মতন যুদ্ধ বন্ধ রাখা হোক, সৈন্যদের তাবুতে ফিরিয়ে আনা হোক, আগামীকাল নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করা হবে। নবাব মেনে নিলেন মীরজাফরের কথা, এছাড়া তাঁর অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। নবাবের আদেশে সৈন্যদের তাবুতে ফিরিয়ে আনা হয়। হঠাৎই বিশ্রাম রত সৈন্যদের উপরে ইংরেজ বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। বিশ্রাম রত নবাবের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। অসহায় নবাব নিজেও পালাতে বাধ্য হলেন। এই যুদ্ধে নবাবের ৫০০ সৈন্য নিহত হয়, আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ২৩ জন সৈন্য এবং আহত হয় ৪৯ জন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বোরখা পরে, প্রথমে গেলেন রাজমহলে সেখানে একজন ফকির নাম, দান শাহ বা শাহ দানের কাছে উপস্থিত হন। ফকির আল্লাহর বান্দা ভেবে নবাব তাকে নিজের পরিচয় দেন এবং তার কাছে সাহায্য চান। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ফকির নবাবকে সাহায্যের নাম করে মীরজাফরের চরের কাছে খবর পাঠিয়ে দেন। মীরজাফরের ভাই মীর দাউদ এসে নবাবকে বন্দি করে এবং চরম অপমান করে। তারপর একটি গরুর গাড়িতে চড়িয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদে আনে। নবাবকে হত্যা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় মুহাম্মদী বেগ’কে। এই মুহাম্মদী বেগ ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাবা জয়ন উদ্দিনউদ্দিনের পালিত ছেলের মতন। সিরাজও তাকে ভাইয়ের মতন ভালোবাসতেন। নিমকহারাম মুহাম্মদী বেগ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অল্প অল্প করে কুড়িটি ছুরির আঘাত করে, যাতে নবাব মৃত্যু যন্ত্রণা পেয়ে মারা যায়। তার পরেও নবাব জীবিত ছিলেন। পরে এক মোঘল সৈন্য তলয়ারের এক কাপে নবাব কে হত্যা করে। দিনটা ছিল ২ রা জুলাই ১৭৫৭ সাল। নবাবের মৃতদেহ একটি হাতির সাথে বেঁধে সারা মুর্শিদাবাদে ঘোরানো হয়। পরে আলিবর্দীর কবরের পাশে বাংলার নবাব কে কবর দেওয়া হয়। সেই সাথে বাংলা স্বাধীনতার সূর্যও অস্ত যায়। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকজন মুর্শিদাবাদের নবাব হয়েছিলেন কিন্তু তারা কেউ স্বাধীন নবাব ছিলেন না। তারা ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল। ইংরেজদের দেওয়া মাসোহারা দিয়েই তাদের নবাবী করতে হতো। (যারা নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তারা হলেন– মীরজাফর, জগৎ শেঠ, রায়দূর্লভ ও অন্যান্যরা।) বাংলার ইতিহাস থেকে তথ্য সংগৃহীত।